বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা

বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা  (১৯১৩ - ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ)


যে মহান মানুষটিকে আমরা ভুলতে বসেছি : "বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা"

মহান মানুষগুলো তখনই সমাজ থেকে হারিয়ে যান, যখন তাঁদের মহান কর্মগুলো বিষয়ে সমাজ আর স্মরণ করে না কিংবা তাঁদের মহান অবদানগুলো বিষয়ে সমাজ আর তুলে ধরার চেষ্টা করে না। এমনই একজন মহান ব্যক্তি হচ্ছেন - শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা।
২রা নভেম্বর এই মহান মানুষটির মৃত্যু বার্ষিকী। এই উপলক্ষে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের পক্ষ থেকে তাঁকে স্মরণ করা হবে কিনা, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলগুলোর পক্ষ থেকে তাঁকে স্মরণ করা হবে কিনা - এসব বিষয়ে আমার জানা নেই। অন্তত এরূপ চিত্র বা তথ্য আমি খুঁজে পাইনি। তাই, অনেকটা পুনরায় সমাজের কাছে এই মহান মানুষটির পরিচয় তুলে ধরার লক্ষ্যে আমার এই লেখা।


👉জন্মঃ


খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে ৩ কিমি দূরে অবস্থিত ত্রিপুরা অধ্যুষিত অন্যতম প্রাচীন লোকালয় ঠাকুরছড়া গ্রামে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ, তথা ১৩২৩ ত্রিপুরাব্দের ১২ তালস্লাং মাসে শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শ্রী শরৎচন্দ্র রোয়াজা ছিলেন মৌজা হেডম্যান, অধিকন্তু একজন সুকবি ও জ্যোতিষ বিশারদ ছিলেন। তখনকার সময়ে শরৎচন্দ্র রোয়াজার পরিবারটি ছিল সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী। সেই পরিবারের একমাত্র সন্তান ছিলেন শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি বি. কে. রোয়াজা নামে সমধিক খ্যাত।


👉শিক্ষা জীবনঃ


ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ছিল অত্যন্ত অবহেলিত ও উপেক্ষিত অঞ্চল। বিশেষ করে যোগাযোগ ও শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। এমতাবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য বি. কে. রোয়াজাকে ৭ বছর বয়স থেকে যৌবনকাল পর্যন্ত বাড়ির বাইরে জীবন কাটাতে হয়।
তিনি রাঙ্গামাটি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রাস, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ হতে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করেন। বি. কে. রোয়াজাই বাংলাদেশের বসবাসকারী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রথম গ্র্যাজুয়েট ব্যক্তি।


👉পারিবারিক জীবনঃ


শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজার সহধর্মীনি ছিলেন - ধনীরং রোয়াজা। সংসার জীবনে তিনি ছিলেন ৫ পুত্র ও ৫ কন্যার জনক। ৫ পুত্র হচ্ছেন- জ্যোতির্ময় রোয়াজা, জগৎ জ্যোতি রোয়াজা, দেবদত্ত রোয়াজা, বীর বিক্রম রোয়াজা, কল্যাণ কিশোর রোয়াজা। ৫ কন্যা - থাইচোক লক্ষ্মী রোয়াজা, কুমকুম রোয়াজা, অর্চনা রোয়াজা, নির্মলা রোয়াজা, কল্যাণী রোয়াজা।


👉কর্মজীবনঃ


কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি রাঙ্গামাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। কয়েক বছর শিক্ষকতা করার পর সরকারি চাকুরীর জন্য ব্রিটিশ সরকারের অধীনে King Commission - এ আবেদন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন King Commission - এ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সুপারিটেন্ডেন্ট ছিলেন Mr. Lance Niblett নামে একজন ইউরোপিয়ান। তিনি ছিলেন পরীক্ষা বোর্ডেরও চেয়ারম্যান। King Commission - এ মৌখিক পরীক্ষা চলাকালীন জেলা সুপারিটেনডেন্ট Niblett সাহেব অসৌজন্যমূলকভাবে বি. কে. রোয়াজাকে বলেছিলেন -
"তোমরা এখনও আদিম সমাজের লোক। King Commission-এ চাকুরীর জন্য তোমাদের সুপারিশ করা যায় না।"
উল্লেখ্য যে, Niblett সাহেব ত্রিপুরা মহারাজার রাজপ্রাসাদ তত্ত্বাবধায়ক পদে ইতিপূর্বে ৩০০/- টাকা মাইনে চাকুরী করেছিলেন। তাই Niblett সাহেবের এরূপ অসৌজন্য উক্তিতে বি. কে. রোয়াজা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন -
"আপনি ইতিপূর্বে ত্রিপুরা মহারাজার রাজ প্রাসাদ তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে চাকুরীতে ছিলেন। পরে চাকুরীচ্যুতও হয়েছিলেন। আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা মেট্রিকুলেশন মাত্র। এ যোগ্যতা নিয়ে যদি আপনি জেলা সুপারিটেনডেন্ট হতে পারেন আর আমি গ্রাজুয়েট হয়েও King Commission - এ উপযুক্ত হবো না? আমি চাকুরী চাইনা।"
এই বলে বি. কে. রোয়াজা কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলে হতবাক Niblett সাহেব আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন এবং বি. কে. রোয়াজা কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হন। সুপারিটেন্ডেন্ট Niblett এর সাথে এরূপ মত পার্থক্যের কারণে চাকুরিতে যোগদান থেকে বিরত থাকেন এবং বর্তমান খাগড়াছড়ি সরকারী উচ্চবিদ্যালয়ে মিডল ইংলিশ থাকতে অবৈতনিক শিক্ষকতা করেন এবং বিদ্যালয়টি বাঁচিয়ে রাখেন।

👉রাজনৈতিক জীবনঃ
ছাত্র অবস্থা থেকেই তিনি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বিশেষ করে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের উন্নতির ক্ষেত্রে আবেদন উপস্থাপনে অতিশয় সোচ্চার ছিলেন। সেইসাথে তিনি সর্বদা চেয়েছিলেন স্বাধীন ত্রিপুরা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। এজন্য তাঁকে দুই দুইবার কারাবরণের শিকার হতে হয়।


*১ম বার গ্রেফতারঃ


১৯৪৭ সালে আগস্টে দেশ বিভাজনের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরাগণ (ত্রিপুরা সংঘ) দাবী উত্থাপন করেছিলেন স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অন্তর্ভুক্ত করার (যেহেতু ঐতিহাসিককাল থেকেই এই অঞ্চলটি স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যেরই অংশ ছিল)। 

এ সময় ত্রিপুরাগণের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা, দয়াভূষণ ত্রিপুরা, পুজগাং মৌজার হেডম্যান মৃত্যুঞ্জয় রোয়াজা, 

তৈকাথাং মৌজার হেডম্যান অন্ন রোয়াজা, মাটিরাঙ্গা মৌজার হেডম্যান অশ্বিনী কুমার রোয়াজা, চেঙ্গী মৌজার হেডম্যান বাধ্য কুমার রোয়াজা, ছোট পানছড়ি মৌজার হেডম্যান জগন্নাথ রোয়াজা, 

বাঙ্গালকাটি মৌজার হেডম্যান গনেশ রোয়াজা প্রমুখ। ত্রিপুরা নেতৃবৃন্দ খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরা রাজ্যের জাতীয় পতাকা (গৈরিক বর্ণের ত্রিকোণাকৃতি হনুমান লাঞ্ছিত) উত্তোলন করেছিলেন। 

প্রধান নেতৃত্ব দেওয়ায় বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা ব্রিটিশ সরকারের কাছে গ্রেফতার হন।


*২য় বার গ্রেফতারঃ


১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যকে ভারতভুক্তির প্রতিবাদের কারণে এবং পার্বত্য জনসেবা সংঘ গঠন করার কারণে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক দ্বিতীয় বারের মত সাময়িক কারাবরণ করেন তিনি। তাঁর এই কারাবরণের অন্য একটি কারণও ছিল যে, মহালছড়ি থানার পুলিশ কর্তৃক ঠাকুরছড়াস্থ তাঁর বাস ভবনে তল্লাসীকালে সিন্দুকের ভেতর রক্ষিত স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের লাল ও হলুদের মাঝখানে সূর্যধ্বজ অঙ্কিত জাতীয় পতাকা পাওয়া গিয়েছিল। পাকিস্তান সরকারের সন্দেহ ছিল যে, তিনি হয়তো এখনো স্বাধীন ত্রিপুরার পক্ষে লড়াই করছেন।


👉প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত এমএলএ ও শিক্ষা উন্নয়ন প্রজেক্ট গ্রহণঃ


১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলের আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে পার্বত্য এলায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য "গণ শিক্ষা সম্প্রসারণ প্রজেক্ট" পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে উপস্থাপন করেন। এই প্রজেক্ট আইয়ুব সরকার কর্তৃক ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে অনুমোদিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাইমারী শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ লাভ করে। 


👉Welfare Officer পদ সৃষ্টিতে অবদানঃ 


পার্বত্যবাসীদের সামাজিক, জাতীয় প্রথা এবং লোকাচারের মতে সুষ্ঠু বিচারকার্য সম্পাদনে কোন সহায়ক গ্রন্থ ছিল না। ফলে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের আদালত সমূহে জটিলতা সৃষ্টি হতো। এ সমস্যা সমাধানকল্পে বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা - পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার ও প্রখ্যাত নেতা জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরীকে Convinced করে এবং তৎকালীন রামগড় মহকুমা প্রশাসক জনাব ওয়াহাব সাহেব, রাজনীতিক জনাব নূর আহমদ, নদের বাঁশী দেববর্মা ও দয়াভূষণ ত্রিপুরা প্রমুখের সহযোগিতা নিয়ে পার্বত্য জেলার তিন মহকুমায় Welfare Officer পদ সৃষ্টি করেন।


👉বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ প্রতিষ্ঠা ও দায়িত্ব পালনঃ

বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ তথা বিটিকেএস প্রতিষ্ঠা লাভ হয়েছিল ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি, তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর ত্রিপুরা। তিনি ছিলেন বিটিকেএস-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা কমিউনিটি দলীয় নেতা হিসাবে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বঙ্গভবনে সাক্ষাৎ করে ১০ লক্ষ টাকা মঞ্জুরি আদায় করে সংসদের কার্যক্রমকে গতিশীল করে তুলেছিলেন। তিনি ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত সরকারী আর্থিক সহযোগিতায় নিয়ে ঠাকুরছড়াস্থ হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
👉পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন ও দায়িত্ব পালনঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের যে সংগঠনটি আজ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুপরিচিত, সেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তথা পিসিজেএসএস প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান অনস্বীকার্য, তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা। তিনি ছিলেন 'পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি'র প্রথম ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তীকালে তাঁকে কেন সেই সংগঠন পরিচালনায় রাখা হয়নি, সেই বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা এবং এম এন লারমার নেতৃত্বে "পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি" প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যা ১৯৮২ সালে বিভক্ত হয়ে এম এন লারমার নেতৃত্বে "পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি" (লাম্বা বা লারমা গ্রুপ) ও ভবতোষ দেওয়ানের নেতৃত্বে "পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি" (বেঁটে বা প্রীতি গ্রুপ) আত্মপ্রকাশ করে, বেঁটে গ্রুপ ১৯৮৫ সালে বিলুপ্ত হয়।

👉স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে মহকুমা ম্যাজিষ্ট্রেট-এর দায়িত্ব পালনঃ
রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মব্যস্তকার মাঝেও শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা স্বীয় যোগ্যতা বলে সরকারি বিচার বিভাগে "বিচারক" হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে খাগড়াছড়ি মহকুমার "অনারারী ম্যাজিষ্ট্রেট" হিসেবে সরকারি প্রজ্ঞাপনে নিযুক্ত হন এবং দীর্ঘ পাঁচ বছর এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। "মহকুমা অনারারী ম্যাজিষ্ট্রেট" এর দায়িত্ব পালন কালে খাগড়াছড়ি জেলাবাসী জনগণ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে লোকাচার ও কুলীয় প্রথানুযায়ী আইনী সুবিধা লাভ করে উপকৃত হয়েছিলেন।
👉সমাজ ও শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানঃ
অতীতে খাগড়াছড়ি পানখাইয়া পাড়ার বিস্তৃর্ণ বিলটি অতিশয় নলখাগড়াপূর্ণ দমদমা ছিল। হাল চাষের মাধ্যমে জমি চাষ করা সম্ভবপর ছিল না। এলাকাবাসী যাতে উপযুক্তভাবে হাল কর্ষণের মাধ্যমে চাষাবাদ করতে পারেন এ উদ্দেশ্যে মারমা নেতা রাজচন্দ্র চৌধুরীর সহযোগিতা নিয়ে Canal System-এর মাধ্যমে আবাদ করার ক্ষেত্র সৃষ্টি করেন শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা।
বর্তমান খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়টি জুনিয়র থাকাকালীন স্কুলটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য অবৈতনিক প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিন বছর এবং সেক্রেটারি হিসেবে আরও তিন বছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সচরাচর পদাধিকার বলে স্কুল পরিচালনায় প্রধান শিক্ষকই সেক্রেটারি পদে দায়িত্ব পালন করার নিয়ম। কিন্তু স্কুলের উন্নয়ন, প্রশাসনিক তদারকি এবং সুষ্ঠু তহবিল অপারেশন করার নিমিত্তে স্কুল পরিচালনা কমিটির স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে বি. কে. রোয়াজা এই দায়িত্ব সম্পাদন করেছিলেন অবৈতনিকভাবে। ফলশ্রুতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান সাহেবকে Convinced করে একটি পূর্ণাঙ্গ স্কুলে পরিণত করে খাগড়াছড়ি জেলার শিক্ষা উন্নয়ন এই মহতী কর্মেরই ফলশ্রুতি।
পার্বত্যবাসীদের জীবন ছিল অনেকটা যাযাবর কেন্দ্রিক। এ অবস্থা দূরীকরণার্থে বি. কে. রোয়াজা ততকালীন মহকুমা প্রশাসক জনাব সামশুদ্দীন সাহেবের সহযোগিতা গ্রহণ করে কল্যাণকর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এটি ছিল "যৌথ খামার' প্রকল্প। যৌথ খামার সৃষ্টি না হলে পার্বত্যবাসীগণ আজও যাযাবর কেন্দ্রিক থেকে যেত, এতে কোন সন্দেহ নেই।
খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান সরকারি কলেজ স্থাপনে ও উন্নয়নে বি. কে রোয়াজার অবদান ছিল অনন্য। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে Convinced করে ২৫ লক্ষ টাকা অনুদান আদায় করে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজটিকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা।
👉রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বঃ
বৃটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আশি দশক পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বি. কে. রোয়াজা সক্রিয় রাজনৈতিক নেতা ছিলেন এবং আমৃত্যু পার্বত্য এলাকায় শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপনে একান্ত প্রত্যয়ী ছিলেন। অধিকন্তু "ট্রাইবেল কনভেনশনেরও" অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা ছিলেন তিনি। ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় ময়দানে হেডম্যান, কার্বারী, সমাজপতি, বুদ্ধজীবি, জনপ্রতিনিধি, সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত এক জনসমাবেশে বি. কে. রোয়াজা এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। সেখানে তাঁর ভাষণে জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, -
"পৃথিবীতে অহরহ মানুষের জন্ম হতে থাকবে। অহরহ মৃত্যুও হতে থাকবে। কিন্তু কোন গুণে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে সে কৌশল জ্ঞানর জানাটাই একান্ত বিবেচ্য। যাঁর রপ্ত আছে তিনি প্রাসাদে থাকুন বা পর্ণকুটিরে থাকুন, তিনিই প্রকৃত জননেতা"।
👉একজন প্রজ্ঞাবান সাদাসিদে মানুষঃ
অধ্যয়ন করা, গান গাওয়া, ক্রীড়া এবং অতিথি আপ্যায়ন ছিল শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজার প্রিয় সখ। তিনি ছিলেন অমায়িক, সুপণ্ডিত ও কর্ম উদ্যোগী ব্যক্তি। পৈত্রিক সূত্রে অগাধ সম্পত্তির মালিক হয়েও অর্থকড়ির ব্যাপারে তিনি ছিলেন একেবারে উদাসীন মনের ব্যক্তিত্ব।
👉মৃত্যুঃ
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের আজকের এই দিনে ঠাকুরছড়া গ্রামে স্বীয় বাসভবনে এই মহান ব্যক্তিটি পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৭২ বছর (১৯১৩ - ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ)।
*************************************

✍️কিছু বিষয় যা হয়তো আপনি এখনো জানেন না
১। বাংলাদেশের প্রায় সকলেই মনে করেন যে, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাই হচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির একমাত্র প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এমনটি মনে হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে - ১০ই নভেম্বরে এম এন লারমা মৃত্যু বার্ষিকী পালন এবং জেএসএসের সকল অনুষ্ঠান, আলোচনা সভায় শুধু তাঁকেই ফোকাসকরণ। বিপরীতে যে মহান মানুষটিকে কখনোই ফোকাস করা হয়না, যে মানুষটিকে জেএসএসের কোন অনুষ্ঠান, আলোচনা সভায় তুলে ধরা হয়না, তিনি হচ্ছেন - শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা, তিনিই ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনিই ছিলেন সংগঠনটির প্রথম সভাপতি।
২। বি. কে. রোয়াজা নামের যে মানুষটি "পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি" (পিসিজেএসএস) নামের সংগঠনটির জন্মদানে অবদান রেখেছিলেন, "ট্রাইবাল কনভেনশনেরও" অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা ছিলেন, সেই মানুষটিকে পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলো কখনই স্বীকার ও স্মরণ করে না। কোন অনুষ্ঠানে, কোন লেখনীতে কিংবা জেএসএসের ইতিহাস বর্ণনায় তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করা হয় না।
৩। বি. কে. রোয়াজা অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার পক্ষে ছিলেন না। কারণ, তিনি জানতেন - অস্ত্র ধারণ করতে গেলে পাহাড়িরাই শরণার্থী হতে বাধ্য হবে। এতে করে হারিয়ে ফেলা ভূমি আর হয়তো ফিরে নাও পেতে পারে। তিনি চেয়েছিলেন পাহাড়িদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী ('আমরাই সবকিছু করবো" নীতি) করে তুলতে এবং গণ আন্দোলনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। এজন্য তিনি সাধারণ সম্পাদক মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে বলেছিলেনঃ- (Muthi le takni rwngya, Silai balni pho!)
"মানবেন্দ্র বাবু, আমরা কার বিরুদ্ধে লড়াই করবো? আমরা দাবা (তামাক) খাওয়ার জন্য যে মুঠি ব্যবহার করি, সেটাতো একজন বাঙ্গালিরই তৈরি, আমরা যে শুটকি মাছ খাচ্ছি, তার পেছনেও তো বাঙালি ব্যবসায়িকদের অবদান আছে। তাহলে, এটাতো পরিষ্কার যে, আমরা অর্থনৈতিকভাবে বাঙালিদের উপর নির্ভরশীল। কাজেই, এই নির্ভরশীলতা ভেঙ্গে ফেলে আমাদের স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে হবে। তাই, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত - অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়ন ও স্বাবলম্বী। অর্থাৎ, আমরাই তৈরি করবো, আমরাই ব্যবসা করবো আর আমরাই নিজেদের মধ্যে কেনাবেচা করবো। তাহলেই বাঙালি ব্যবসায়িকেরা আর টিকে থাকতে পারবে না, ফলে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পার্বত্য ভূমি ছেড়ে চলে যাবে। আর আমরা যদি স্বাবলম্বী হই, তাহলে আমাদেরকে থামিয়ে দেওয়ার মত সাহস বাংলাদেশ সরকারের আর থাকবে না।"
উল্লেখ্য যে, সত্তরের দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল। সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ৮ শতাংশের অধিক ছিল না। এদের বেশীর ভাগই ছিল ব্যবসায়ী, যাদের উপর পাহাড়ি-আদিবাসীরা অর্থনৈতিক কিংবা বাজারগতভাবে নির্ভরশীল ছিল। ব্যবসার খাতিরে এবং কর্মসূত্রে এই ৮ শতাংশের বাঙালিরা পুরো পার্বত্য অঞ্চলে চষে বেরিয়েছিল, পাহাড়িদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, ভূমি বন্দোবস্ত করে নিয়েছিল, পার্বত্য অঞ্চলের ভূমির প্রাচুর্যটা সম্পর্কে নিকটাত্মীয়দের অবগত করে ডেকে নিয়ে এসেছিল এবং অবশেষে (৮০'র পরবর্তী সময়ে) সেটেলার বাঙালি আভিবাসনের মাধ্যমে ভূমিগ্রাস করার লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিল।
তাই, ৭১-৭৫ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজার মতাদর্শটি অনেকটা শক্তিশালী ও অতীব জরুরি ছিল। কারণ, তখনও বাঙালি সেটেলার আনা হয়নি। কাজেই পাহাড়িরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়ন ও স্বাবলম্বী হলে, ৮ শতাংশের বাঙালিরা তাদের ব্যবসা ও কর্মক্ষেত্র গুটিয়ে এমনিতেই চলে যেত। কিন্তু মানবেন্দ্র বাবু সশস্ত্র আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। সম্ভবত এই কারণে, পরবর্তী কালে বীরেন্দ্র বাবুকে 'জনসংহতি সমিতি'তে আর রাখা হয়নি কিংবা তিনি থাকতে চাননি।
৪। মানবেন্দ্র চেয়েছিলেন ভারত সরকার ও গোয়েন্দা RAW'র সহযোগিতা নিতে। RAW'র কর্মকর্তারা মানবেন্দ্রকে বুঝিয়েছিলেন যে, যদি পাহাড়িরা শরণার্থী হয়, তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি ফোকাস পাবে এবং প্রয়োজনে চাকমাদেরকে বিশেষভাবে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। [ঠিক যেমনটা ভারতের পাঁচটি রাজ্যে (ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, অরুণাচল, পশ্চিমবঙ্গ) চাকমাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে]। এরূপ বিশ্বাসে মানবেন্দ্র ভারতের কথামতো চলতে বাধ্য হন। যদিও পরবর্তীতে তিনি চীনাপন্থী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে, সংগ্রাম যতটা বেগবান হওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে ঘোলাটে হয়ে যায়।
৫। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ সহায়তায় শান্তিবাহিনী গঠিত হয়। এর প্রধান কার্যালয় পার্বত্য চট্টগ্রামে রাখা হলেও প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয় ত্রিপুরা রাজ্যে ও মিজোরাম রাজ্যে। ফলে চাকমাদের এক বিরাট অংশ ত্রিপুরা রাজ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশের সুযোগসহ নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। ফলে দ্রুত ত্রিপুরা রাজ্যে চাকমাদের জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন ডিভিশনের মাধ্যমে শান্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়। নির্দেশ এও দেওয়া হয় যে, শান্তিবাহিনীর কোন সদস্য চাকমা মেয়ে বাদে অন্য কোন জাতির মেয়ে বিয়ে করতে পারবে না। ফলে শান্তিবাহিনীতে থাকা ত্রিপুরা কর্মীদের একাংশ বিয়ে করতে বাধ্য হয় চাকমা মেয়েদের।
৬। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে দলকে নির্দেশ দেওয়া ছিল যে, গেরিলা প্রশিক্ষণ শিবিরে যেন ত্রিপুরাদের কম প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ, তাদের ধারণা ছিল ত্রিপুরারা স্বাধীন ত্রিপুরার পক্ষাবলম্বন করে থাকতে পারে, যা ভারতের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই জনসমিতি ও শান্তিবাহিনীতে থাকা ত্রিপুরাদের বেশীর ভাগকে অন্য কাজে লাগানো হয়, প্রধানত চাঁদা আদায় কিংবা মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহে ও কর্মী সংগ্রহে। এরূপ কাজের কারণে, তারা ধীরে ধীরে ককবরক ভুলে গিয়ে চাকমা ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে এবং চাকমাদের সাথে মিউচুয়াল সম্পর্ক গড়ে তোলে। এমনকি পরবর্তীকালে তাদের একাংশ স্বজাতির মেয়ে বিয়ে না করে চাকমা মেয়ে বিয়ে করে ফেলে। (এরূপ সম্পর্ক আজও চলমান! এমনকি বর্তমানে রাজনীতিতে যুক্ত ত্রিপুরা মেয়েরাও চাকমা ছেলে বিয়ে করছে!!!)

Post a Comment

0 Comments